মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘দ্বিনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদেরকে তোমাদের বাড়ি-ঘর থেকে বের করে দেয়নি, তাদের প্রতি সদয় ব্যবহার করতে এবং তাদের প্রতি ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ তোমাদের নিষেধ করছেন না। নিশ্চয় আল্লাহ ন্যায়পরায়ণদের ভালোবাসেন। আল্লাহ শুধু তাদের সঙ্গেই বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করেছেন, যারা দ্বিনের ব্যাপারে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে এবং তোমাদেরকে তোমাদের বাড়ি-ঘর থেকে বের করে দিয়েছে এবং তোমাদের বের করে দেওয়ার ব্যাপারে সহায়তা করেছে। আর যারা তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে, তারাই তো জালিম।
’ (সুরা : মুমতাহিনা, আয়াত : ৮,৯)
অন্যত্র মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘হে মুমিনরা, তোমরা তাদের বন্ধুরূপে গ্রহণ কোরো না, যারা তোমাদের দ্বিনকে উপহাস ও খেল-তামাশারূপে গ্রহণ করেছে, তাদের মধ্য থেকে তোমাদের আগে যাদের কিতাব দেওয়া হয়েছে ও কাফিরদের। আর আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করো, যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাকো। ’ (সুরা : মায়েদা : আয়াত : ৫৭)
ঐতিহাসিকভাবে ইসলামে অমুসলিমদের অধিকার
সাধারণ অমুসলিমদের সঙ্গে লেনদেনসহ যাবতীয় সামাজিক শিষ্টাচার রক্ষা করা বৈধ এবং ক্ষেত্রবিশেষ প্রশংসনীয়ও বটে। তবে ইসলামবিদ্বেষী ও মুসলমানদের ওপর আক্রমণাত্মক মনোভাবাপন্ন অমুসলিমদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা বৈধ নয়।
ঐতিহাসিকভাবেই ইসলাম অমুসলিমদের অধিকার সুনিশ্চিত করেছে। অন্যের উপাসনালয় ভেঙে ফেলার অনুমতি ইসলাম দেয়নি। মসজিদ, মন্দির বা গির্জায় হামলা করা ইসলামের দৃষ্টিতে নিন্দনীয়। ওমর ইবনে আবদুল আজিজ (রা.)-এর শাসনের আগে খ্রিস্টানদের একটি গির্জা ভেঙে মুসলমানরা মসজিদ বানিয়েছিল। ওমর ইবনে আবদুল আজিজ (রা.) খেলাফত গ্রহণের পর খ্রিস্টানরা এ অভিযোগ নিয়ে খলিফার দরবারে গেলে তৎক্ষণাৎ এক ফরমান পাঠিয়ে খ্রিস্টানদের গির্জা যেভাবে ছিল, ঠিক সেভাবে তৈরি করে দেওয়ার নির্দেশ দেন। ইসলামের প্রথম খলিফা আবু বকর (রা.) হিরা নামের স্থানের সংখ্যালঘু খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সঙ্গে নিরাপত্তাসংক্রান্ত যে চুক্তি করেছিলেন, তাতে উল্লেখ রয়েছে, ‘তাদের গির্জা তথা ধর্মীয় উপাসনালয় ধ্বংস করা যাবে না এবং তাদের ঘরবাড়ি ভেঙে দেওয়া যাবে না। ঘণ্টা বাজানো থেকে তাদের নিষেধ করা যাবে না। ধর্মীয় উৎসব উদযাপনের সময় ধর্মীয় প্রতীক ক্রুশ বের করাতে বাধা দেওয়া যাবে না। ’ (ফাতাওয়া হক্কানিয়া : ৫/৪৮৫)
ওমর (রা.) বায়তুল মুকাদ্দাসের খ্রিস্টানদের সঙ্গে একটি চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিলেন। তাতে উল্লেখ ছিল, ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। এটি একটি নিরাপত্তাসংক্রান্ত চুক্তিনামা, যা মুসলমানদের আমির, আল্লাহর বান্দা ওমরের পক্ষ থেকে স্বাক্ষরিত হলো, এ চুক্তিনামা ইলিয়াবাসী তথা জেরুজালেমে বসবাসরত খ্রিস্টানদের জানমাল, গির্জা-ক্রুশ, সুস্থ-অসুস্থ তথা খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের জন্য প্রযোজ্য। সুতরাং চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর তাদের উপাসনালয়ে অন্য কেউ অবস্থান করতে পারবে না। তাদের গির্জা ধ্বংস করা যাবে না। কোনো ধরনের ক্ষতিসাধন করা যাবে না। তাদের নিয়ন্ত্রিত কোনো বস্তু, তাদের ধর্মীয় প্রতীক ক্রুশ ও তাদের সম্পদের কোনো ধরনের ক্ষতিসাধন বা হামলা করা যাবে না। ’ (তারিখুর রাসুল ওয়াল মুলুক, তারিখে তাবারি, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৪৯)
মুসলিমদের নিরাপত্তায় হুমকিস্বরূপ কাজ থেকে নিবৃত থাকা অপরিহার্য
ইমাম সারখসি (রহ.) লিখেছেন, মুসলিম এলাকায় অমুসলিমদের কাছে মুসলিমদের জমিজমা ও ঘরবাড়ি বিক্রয় করা বৈধ। কেননা ওমর (রা.)-এর যুগেও তিনি এর অনুমতি দিয়েছিলেন। তবে যদি এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, যার কারণে তা মুসলিমদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায় এবং মুসলিমদের এলাকা বেদখল হওয়াসহ যাবতীয় আশঙ্কা দেখা দেয় তাহলে কোনোক্রমেই অমুসলিমদের কাছে মুসলিমদের জমিজমা ও ঘরবাড়ি বিক্রয় করা বৈধ হবে না। (শরহুস সিয়ারিল কাবির : ৪/২৬৫)
আল্লামা ইবনে আবেদ্বিন শামি (রহ.) বলেন, অমুসলিমদের কাছে যুদ্ধাস্ত্র বিক্রয় বৈধ নয়, কেননা এতে তাদের শক্তি বৃদ্ধির মাধ্যমে মুসলিমদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি রয়েছে। (রদ্দুল মুহতার ৪/২০৭)
ইহুদিদের কাছে ফিলিস্তিনের জমি বিক্রয় নিয়ে থানবি (রহ.)-এর ঐতিহাসিক ফতোয়া
ইহুদিদের কাছে ফিলিস্তিনের জমি বিক্রয়ের বিধান বিষয়ক থানবি (রহ.)-কে প্রশ্ন করা হলে তিনি তদুত্তরে লেখেন, মুসলিমদের নিরাপত্তার জন্য যদি হুমকি হয়ে দাঁড়ায় এবং মুসলিমদের এলাকা বেদখল হওয়াসহ যাবতীয় আশঙ্কা দেখা দেয়, তাহলে কোনোক্রমেই করদাতা জিম্মি অমুসলিমদের নিকটও মুসলিমদের জমিজমা ও ঘরবাড়ি বিক্রয় করা বৈধ হয় না। এমতাবস্থায় দখলদার ও হানাদার ইহুদিদের কাছে ফিলিস্তিনের জমি বিক্রয় করা তো বৈধ হওয়ার প্রশ্নই আসে না। আর এতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে অমুসলিম হানাদারদের সাহায্য হয়ে থাকে, যা সম্পূর্ণ হারাম। (ইমদাদুল ফাতাওয়া ৩/৫৯-৬০, বাওয়াদিরুন নাওয়াদির পৃষ্ঠা ৪৫৮-৪৬০)
কোরআনে কারিমে মন্দকর্ম ও সীমা লঙ্ঘনে সহযোগিতাকে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘সৎকর্ম ও তাকওয়ায় তোমরা পরস্পরের সহযোগিতা করো। মন্দকর্ম ও সীমা লঙ্ঘনে পরস্পরের সহযোগিতা কোরো না। আর আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ আজাব প্রদানে কঠোর। ’ (সুরা : মায়েদা, আয়াত : ২)
ইদানীং আমাদের দেশের পার্বত্য এলাকাসহ সীমান্তবর্তী কিছু গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় বিদেশি মিশনারিদের তৎপরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেখানেও তাদের কাছে জমাজমি বিক্রয় করা যদি ভবিষ্যতে বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়, তবে তা থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। উল্লিখিত কোরআন-হাদিস ও ফোকাহায়ে কেরামের উদ্ধৃতিগুলোর আলোকে বিদেশি মিশনারিদের কাছে আমাদের মালিকানা জমি বিক্রয়ের বিধানও স্পষ্ট হয়ে গেছে যে তা কোনো মুসলিমের জন্য করা বৈধ হবে না। অতএব বাংলাদেশের মুসলিমদের জন্য এ বিষয়ে সতর্ক হওয়া আবশ্যক। আল্লাহ তাআলা তাওফিক দান করুন!
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।